ঢাকা,সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

কক্সবাজারে ওএমএসের নিম্নমানের আটা বিক্রি বিপাকে হতদরিদ্ররা

indexএম.শাহজাহান চৌধুরী শাহীন,কক্সবাজার, ১৮ ফেব্রুয়ারী ॥

কক্সবাজার পৌরসভার ১২টি ওয়ার্ডে খোলাবাজার আটা বিক্রি কর্মসূচির (ওএমএস) আওতায় যে আটা বিক্রি করা হচ্ছে তা অত্যন্ত নিম্নমানের। কিছু কিছু বস্তার আটা থেকে দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। এ কারণে যাঁদের জন্য এই কার্যক্রম, সেই দরিদ্রদের কোনো উপকার হচ্ছে না। উপরন্তু খোলা বাজারে বিক্রি বা ওএমএস কম দামের আটা কিনতে না পেরে দরিদ্ররা বিপাকে পড়েছেন। খাদ্য অধিদপ্তরের নজরদারি না থাকায় এসব ওএমএস দোকানে হযবরল অবস্থা বিরাজ করছে বলে জানা গেছে।

সংশ্লিষ্ঠ সুত্রে জানা গেছে, কম দামে দরিদ্রদের কাছে আটা বিক্রির জন্য গত জানুয়ারীর শুরু থেকে কক্সবাজার পৌরসভার ১২টি স্থানে ওএমএস কার্যক্রম শুরু করে খাদ্য অধিদপ্তর। এ ব্যাপারে এলাকায় মাইকিংসহ ব্যানার টাঙ্গিয়ে প্রচার চালানোর কথা থাকলেও তা করা হয়নি। ওএমএসের আটা বিক্রির জন্য পৌরসভা এলাকায় ৪টি মিল মালিককে গম সরবরাহ দেয়া হয়। পৌর এলাকার ১২টি ওয়ার্ডে একজন করে মোট ১২ জন ডিলার নিয়োগ দেয়া হয়। মিল মালিকরা গম মিলিং করে অনুমোদিত ডিলারদের আটা সরবরাহ দেন। গত জানুয়ারী থেকে শহরে শুধুমাত্র আটা বিক্রি করা হচ্ছে। চালের মুল্য স্থিতিশীল থাকায় ওএমএসএর চাল বিক্রির বন্ধ রয়েছে।

জেলা খাদ্য অধিদপ্তর সুত্র মতে, খাদ্য বিভাগের অনুমোদিত মিলগুলোর মধ্যে রয়েছে; শহরের তাজ রেজা, মধুমিতা, নাহিয়ান ও কক্সবাজার ফ্লাওয়ার মিল। প্রত্যেক অনুমোদিত মিল মালিক টন প্রতি ১৮ হাজার টাকা (কেজি প্রতি ১৮ টাকা ) দরে কিনে ( প্রতিদিন ১২ মেট্্িরক টন ) গম সরকারি খাদ্যগুদাম থেকে তুলে বিক্রয়কেন্দ্রে গুলোতে ১৯ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেন। সরকারী নিয়মানুযায়ী একজন ক্রেতা সর্বোচ্চ ৫ কেজি আটা কিনতে পারবেন। শনিবার ছাড়া সপ্তাহের বাকি ছয় দিন সকাল নয়টা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত আটা বিক্রির নিয়ম রয়েছে। কক্সবাজার সদর উপজেলা গেইটের সামনে, আলীর জাহাল, রুমারিয়ারছড়া, গোলদীঘিরপাড়, টেকপাড়া, বৈদ্যঘোনা, পিটিআই স্কুলের সামনে, নতুন বাহারছড়া, উত্তর নুনিয়াছড়া, গাড়ীর মাঠ, সমিতিপাড়া ও কলাতলি মোড় এলাকায় রয়েছে ওএমএস দোকান বা ডিলার। এসব দোকানে গম বিক্রি করলেও! বেশির ভাগ ডিলার সরকারী নিয়মনীতি কিছুই মানছেন না।

সুত্র আরো জানায়, খাদ্য বিভাগ থেকে বরাদ্দ পাওয়া প্রতিদিন ১২ টন গম ৪টি মিলে মিলিং করা হয়। কিন্তু ডিলাররা প্রতিদিন ২ থেকে ৩ বস্তা আটা দোকানে আনেন। দরিদ্ররা কিনতে গেলে বিক্রি শেষ হয়েছে বলে তাড়িয়ে দেন।

এমনও অভিযোগ রয়েছে, দরিদ্রদের কাছে আটা বিক্রির নামে সরকার থেকে বরাদ্দ নিয়ে তা উচ্চ মুল্যে শহরের পাইকারী ও খুচরা দোকানিদের নিকট বিক্রি করেন। বর্তমানে বাজারে প্রতি কেজি ভালমানের প্যাকেটজাত আটার মুল্য ৩৫ টাকা। আর খোলা আটা ২৫ থেকে ৩০ টাকা।

শনিবার বাদে সপ্তাহের অন্যান্য দিনগুলোতে আটা বিক্রি করা হয় এসব অনুমোদিত ডিলারগুলোতে। কিন্তু প্রায় সময় বন্ধ থাকে বেশির ভাগ ওএমএস ডিলার। অনেক ডিলার দাবী করেন, সরবরাহ না থাকায় বন্ধ রাখা হয়।

বুধবার ১৭ ফেব্রুয়ারী সকাল সাড়ে ১০টায় পৌরসভার ৭নং ওয়ার্ডের দক্ষিণরুমালিয়ার ছড়া এলাকার মেসার্স এসএম এন্টারপ্রাইজ নামের খাদ্য অধিদপ্তর পরিচালিত ওএমএস দোকানটি মহাসড়কের পাশের একটি চাল বিক্রির দোকানে। সেখানে কোনো ক্রেতা পাওয়া যায়নি। ডিলারের প্রতিনিধি আধা বস্তা খোলা আটাসহ দেড় বস্তা আটা নিয়ে বসে আছেন। তিনি বলেন, ‘মানুষ এলে তাদের আটা দিয়ে দিই।’

বুধবার দুপুরে ৫নং ওয়ার্ডের আলীর জাহালস্থ মেসার্স ইয়াছির এন্টারপ্রাইজ নাম বিক্রয়কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, একটি ছোট দোকানঘরে কাঠের তৈরি কয়েকটি থাক সাজিয়ে রাখা হয়েছে। তিন আটা নিয়ে ডিলার এর প্রতিনিধি ষাটোর্ধ এক ব্যক্তি বসে আছেন। সামনে সাজিয়ে রাখা হয়েছে পান বিক্রির একটি শো কেইচ। বাকি আটার ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বাইরের আরেকটি ঘর দেখিয়ে বলেন, ওখানে মজুদ রয়েছে।

শহরের গোলদিঘীরপাড়স্থ ওএমএস দোকানটি বন্ধ পাওয়া যায়। বাইরে দোকানের নাম বা ওএমএস এর কোন ব্যানারও নেই। পার্শ্ববর্তী দোকানিরা জানান, এই বিক্রয় কেন্দ্রটি প্রায় সময় বন্ধ থাকে।

১০ নং ওয়ার্ডের বাহারছড়া বাজারস্থ (পিটিআই স্কুলের সামনে) বিক্রয়কেন্দ্রে দেখা যায়, চায়ের দোকানের সামনে একটি ব্যানার টানানো রয়েছে। দোকানের ভেতরে কয়েক বস্তা চাল ও গমের দেখা গেলেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ক্রেতা পাওয়া যায়নি।

শহরের গাড়ীর মাঠ এলাকার বিক্রয়কেন্দ্রে গিয়ে কোনো ক্রেতা পাওয়া যায়নি। ডিলারের এক প্রতিনিধি বলেন, আটার মান এতই খারাপ যে কোনো ক্রেতা নিতে চান না। কয়েকটি বস্তা খুলে দেখা যায়, ধুলা মেশানো ও অর্ধভাঙ্গা আটা। আটা থেকে দুর্গন্ধ বের হচ্ছে।

কক্সবাজার সদর উপজেলা গেইটের সামনে ওএমএস ডিলার নাম মাত্র রয়েছে। ওই ডিলার দোকানের সামনে কোন ব্যানার টাঙ্গায়নি। এমনকি আটা বিক্রির কোন নমুনাই সেখানে দেয়া যায়নি। তিনি সরকারী ভাবে আটা বিক্রির জন্য ওএমএস দোকান নিলেও সরকারী কোন নিয়মনীতি তিনি মানেন না।

পৌরসভার ১নং ওয়ার্ড উত্তর নুনিয়াছড়া ওএমএস দোকান থেকে আটা কিনে নেয়া একজন গ্রাহক জানান, পুরোনো গমের আটা হওয়ার কারণে এর গুণগত মান নষ্ট হয়ে গেছে। আটার গুঁড়া ধরলে হাত গন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কিছু কিছু বস্তার আটা থেকে দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। এই দুর্গতির অবস্থা বিরাজ করছে অন্যান্য ওএমএস দোকানগুলোতেও।

এদিকে, খাদ্য অধিদপ্তরের সরবরাহ করা গম থেকে তৈরি আটা অত্যন্ত নিম্নমানের। এ অভিযোগ স্বল্প ও সীমিত আয়ের মানুষের । যে আটা কেনা হচ্ছে তা চার-পাঁচ দিনের বেশি মজুত থাকলে পোকা হয়। নিম্নমানের এই আটা বিতরণ করার পর দরিদ্রদের মনে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে। খাদ্য বিভাগের কোন নজরদারি না থাকায় ওএমএস দোকানগুলোতে এই হযবরল অবস্থা বিরাজ করছে বলে সাধারণ ক্রেতাদের অভিমত। আটায় একধরনের গন্ধ, ছোট ছোট পাথর ও পোকা থাকে। এতে দরিদ্র পরিবারের সদস্যদের নানা রকম পেটের পীড়ার সম্মুখীন হতে হয়।

খোলাবাজারে বিক্রির জন্য সরকারি খাদ্যগুদাম থেকে ৪টি মিলের বিপরীতে প্রতিদিন ১২টন গম সরবরাহ করা হয়, তা নিয়ে ক্ষোভের অন্ত নেই দরিদ্রদের মাঝে। এই গমকে অত্যন্ত নিম্নমানের ও দুর্গন্ধযুক্ত দাবী করেন ক্রেতারা। তবে খাদ্য বিভাগ তাদের গম নিম্নমানের নয় দাবি করে বলেছে, সরবরাহের আগে এই গম তাদের পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করে যে প্রতিবেদন পেয়েছে, তাতে কোনো বিরূপ মন্তব্য করা হয়নি। অর্থাৎ তাদের সরবরাহ করা গমে কোনো সমস্যা নেই।

আর খাদ্য বিভাগের দৈনিক খাদ্যশস্য বিষয়ক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে উন্নতমানের গম আমদানি করলে প্রতি কেজি গমের দাম দাঁড়ায় ১৯ টাকা। আর বাজারে প্রতি কেজি গম বর্তমানে ১৯ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

তবে খাদ্য বিভাগ সাধারণ মানুষের এ অভিযোগ মানতে নারাজ। কক্সবাজার সদর খাদ্য গুদাম কর্মকর্তা (ওসি এলএসডি) থোয়াইমং এর মতে, গম ও আটার গুণগত মান পরীক্ষা করা হয়েছে। এতে আটা বা গমের মানের বিষয়ে কোনো ধরনের বিরূপ মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

নিম্নমানের গম আমদানি কীভাবে হলো, জানতে চাইলে কক্সবাজার জেলা খাদ্য কর্মকর্তা ( ভারপ্রাপ্ত ) ও সদর উপজেলার খাদ্য কর্মকর্তা মোঃ শাহ জামাল বলেন, ব্রাজিল থেকে গম আমদানির ক্ষেত্রে নিয়মের ব্যত্যয় ঘটেনি। সবার মতামত নিয়ে আইন মেনে গম আমদানি হয়েছে। এই গম অখাদ্য নয়। গমের মান ভালো। তাই আটাও ভালো হচ্ছে বলে দাবী করেন তিনি।

পাঠকের মতামত: